Friday, May 17, 2019

প্রকৃত বৈষ্ণব কে? প্রকৃত বৈষ্ণের সংজ্ঞা কি?

প্রকৃত বৈষ্ণব কে?
বেদবিদ্যানুরক্তা যে বিপ্রভক্তিরতাঃ সদা।
    নপুংসকা পরস্ত্রীষু জ্ঞেয়াস্তে বৈষ্ণবা জনাঃ।।
অনুবাদ-যাহারা বেদবিদ্যানুরক্ত,সর্ব্ব বিপ্রভক্ত ও পরদারবিমুখ
তাহারাই বৈষ্ণবজন।।
                (পদ্মপুরান,ক্রিয়াযোগসারঃ২/৯০)
নব্য বৈষ্ণব --এনারা'বিপ্রভক্তিরতা'তো দূরের কথা ব্রাহ্মণদের অপদস্হ করতে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকেন এবং বর্ণাশ্রম  মানেন না
তাছারা কলির ব্রাহ্মণদের 'রাক্ষস' বানানোর জন্য ভুয়া শ্লোখ তৈরী করতেও এনারা ওস্তাদ।এনাদের লিখিত পুস্তকে পাওয়া যায়।
কলিযুগে রাক্ষস -সকল-বিপ্রের ঘরে।
    জন্মিবেক সুজনেরে হিংসা করিবারে।
ইত্যাদি বলে বরাহ পুরানের একটি খন্ডিতাংশ প্রয়োগ করে।
সমাধান-অনুসন্ধানপূর্বক দেখা গিয়াছে রবাহ পুরানে ঐরকম কোন শ্লোখ অস্তিত নেই।যদি কলির ব্রাহ্মণ রাক্ষস হয়,তবে শ্রীচৈতন্য  মহাপ্রভু, শ্রীমন্নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, শ্রীঅদ্বৈত মহাপ্রভু, গদাধর,শ্রীবাস,শ্রীরুপ গোস্বামী, শ্রীসনাতন গোস্বামী, শ্রীজীব গোস্বামী প্রভৃতি প্রধান প্রধান বৈষ্ণবচার্য্যগণের পরিচয় কি?কারণ'তাঁরা প্রত্যেকেই তো ব্রাহ্মণ সন্তান! সেজন্য প্রকৃত বৈষ্ণব সর্বদা বর্ণধর্মের পালন করবে এবং ব্রাহ্মণগণের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে চলবে।ব্যাসদেব বলেছেন'
        পাষণ্ডসঙ্গরহিতা বিপ্রদ্বেষবিবর্জ্জিতাঃ।
        সিঞ্চেয়ুস্তুলসীং যে চ জ্ঞাতব্যা বৈষ্ণবা নরাঃ।।
অনুবাদ-যাঁহারা পাষণ্ডসঙ্গ করেন না।ব্রাহ্মণে যাহাদের দ্বেষ নাই,এবং যাঁহারা তুলসী তরু সেক করেন,সেই নরগণকেই বৈষ্ণব বলিয়া জানিবে, 
এবিষয়ে এই ভিডিও আলোচনাটি দেখলে আরো  কিছুটা সহজে বুঝতে পারবেন। 

  
                      (পদ্মপুরান, ব্রহ্মখণ্ড ১/২৬)
অথ চ যস্ত্বিহ বা আত্নসম্ভাবনেন স্বয়মধমো
    জন্মতপোবিদ্যাচারবর্ণাশ্রমবতো বরীযকো ন বহু মন্যেত স 
    মৃতক এব মৃত্বা ক্ষারকর্দমে নিরয়েহবাক্ শিরা নিপাতিতো
    দুরন্তা যাতনা হ্যশ্নুতে।।
অনুবাদ- যে ব্যক্তি নিম্ন শ্রেনীতে জন্মগ্রহন করেও মিথ্যা অহংকারে জন্ম,তপস্যা,বিদ্যা,আচার,বর্ণ ও আশ্রম উৎকৃষ্ট পূজনীয় ব্যক্তির সম্মান না করে,সেই ব্যক্তি জিবন্নৃত।দেহান্তে তাহাকে ক্ষারকর্দম নামক নরকে অধোমুখ করিয়া নিক্ষেপ করা হয় এবং সেখানে তাকে দুরন্ত যাতনা ভোগ করিতে হয়।
ব্রাহ্মণের দ্বেষকারী ব্যক্তির ভগবানের আরাধনার কোন ফলই
   হয় না।দেখুন"
   যো বা কো বাপি বিপ্রেন্দ্র বিপ্রদ্বেষপরায়ণঃ।
   যদ্যর্চ্চয়তি গোবিন্দং সা পূজা বিফলা ভবেৎ।।
অনুবাদ- ব্রাহ্মণ প্রতি দ্বেষ-পরায়ণ যে কোন ব্যক্তি,যদি ভগবান্ গোবিন্দ্রের পুজা করে,তাহা হইলে তৎকৃত সেই পুজা বিফল হইবে।
                  (বৃহন্নারদীয়া পুরান'৩৫/৬)
 একদিকে মর্কট বাবাজীগণ বলেছেন,কলির ব্রাহ্মণ রাক্ষস, আরেকদিকে শাস্ত্রে কি বলা আছে দেখুন।
জৈমিনি ঋৃষি বলেছেন,
     তস্মৎ কলিযুগে তস্মিন ব্রাহ্মণো বিষ্ণুরেব চ।
     উভৌ গতিশ্চ সর্ব্বেষাং---!!
অনুবাদ- এই জন্য সেই বিষম কলিযুগে ব্রাহ্মণ ও বিষ্ণু এই উভয়ই
সকলের গতি।
       (স্কন্দপুরান,বিষ্ণুখন্ডে,পুরুষোত্তমহক্ষেত্রমাহাত্ন ৩৮/৪৪)
                      ''  তাই সাধু সাবধান,,
     
যারা পিতামাতা কে বরণপোষণ না করে ছুরে ফেলে,বৈষ্ণব  হওয়া জন্য পাগল"তাদের জন্য শাস্ত্রীয় কিছু রেফারেন্স  "দেখুন।
বৃহদ্ধর্ম পুরানে ব্যাসদেব বলেছেন"
  ♣পিতা যস্য ক্কচিদ্রুষ্টো ন তস্য কস্যচিদগতিঃ।
      জপো দানং তপো হোমম স্নানং তীর্থক্রিয়াবিধিঃ।
      বৃথৈব তস্য সর্ব্বাণি কর্ম্মাণ্যন্যানি কানিচিৎ।।
      করোতি সর্ব্বদেবেশং পিতরজ্ঞনুতপ্য যঃ।
       জপানি বিফলং তত্র দুগ্ধকক্ষিত্যুপ্তবীজবৎ।।
অনুবাদ- পিতা যাহার কখনও রুষ্ট হন,তাহার গতি কোথাও নাই,জপ,দান,তপস্যা,হোম,স্নান,তীর্থসেবা,বা অনন্য সমস্ত কর্ম্মই তাহার বিফল।সর্ব্বদেবতাশ্রেষ্ট পিতার উপাসনা না করিয়া যে,কোন ধর্ম্মকার্য্য করে,পিতার অনুতাপরুপ তীব্রবিষ যে পুত্রকে দুগ্ধ করে,প্রজ্বলিত ক্ষেত্রে রোপিত বীজের ন্যায় তাহার জপাদি ধর্ম্মকার্য্য বিফল হইয়া তাকে।
                (বৃহদ্ধর্ম পুরান,পূর্বাবখন্ড ১/১৮,১৯)

♣পিতৃভক্তা মাতৃভক্তা জ্ঞাতিপোষণতৎপরাঃ।
    ধর্ম্মেপদোশিন যে চ জ্ঞেয়াস্তে বৈষ্ণবা জনাঃ।।
অনুবাদ- যাহারা পিতৃমাতৃভক্ত, জ্ঞাতিপোষণরত, ও ধর্ম্মেপদোশক, তাহারাই বৈষ্ণব জন।
                 (পদ্মপুরান, ক্রিয়াযোগসারঃ২ /৮৮)

ভগবান ব্যাস বহুপূর্বেই বলেছিলেন"
♣মধুদর্শিতামার্গেন পাপিষ্ঠা বৈষ্ণবাঃ কলৌ।
    ভবিষ্যন্তি ততো ম্লেচ্ছাঃ শুদ্র যূথবহিস্কৃতাঃ।।
অনুবাদ--কলিকালে মধু-দর্শিতা-পথানুসারী পাপিষ্ঠ বৈষ্ণব অনেক হইবে,অনন্তর জাতিব্ষ্ট শূদ্র এবং ম্লেচ্ছাগণ-এই বৈষ্ণব পথাবলম্বী হইবে।
                     (সৌরপুরান-৩৯/৭৯)
শ্রীভগবান বলেছেন
 ♣মন্যুর্নিপততে যস্মিন পুত্রে পিত্রোশ্চ নিত্যশঃ
     তন্নিরয়ং নাবাধেহহংন ধাতা ন চ শঙ্করঃ।।
অনুবাদ-যে পুত্রের প্রতি পিতা বা মাতার কোপ নিপতিত হয়,আমি বিধাতা বা শঙ্কর আমরা কেহই তাহার নরক লাভের অন্তরায় হইতে পারি না।।
                    (পদ্মপুরান, সৃষ্টিখন্ড,৫০/১৭১)
দেবতা পূজা, মা বাবা ও অতিথি সেবা এবং আচার্যপথ অনুসরণ প্রসঙ্গেঃ                                                 ইসকন পন্থী বৈষ্ণব ও অন্যান্য বৈষ্ণবদের কেউ কেউ বলে থাকেন ,কৃষ্ণ উপাসনা করলে দেবতার পূজা এবং মা বাবার সেবা করার কোন প্রয়োজন নেই ।আমি মনে করি পরমেশ্বরের উপাসনার পাশাপাশি দেবতার পূজা ও মা বাবার সেবা করা অবশ্য কর্তব্য যা শাস্ত্রাজ্ঞা ।দেবতা সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরের এক একটি শক্তি।দেবতা সাক্ষাত ঈশ্বর এবং মা বাবা সাক্ষাত দেবতা ।দেবতা ও মা বাবার সেবা ব্যতিরেকে সকল উপাসনা নিষ্ফল ।মা বাবাকে আঘাত দিয়ে ব্রহ্মচারী হওয়াও সঠিক নয়।কেবল মা বাবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে বাবা মার অনুমতি সাপেক্ষে আখড়ায় অবস্থান করা ও ব্রহ্মচারী হওয়া বাঞ্ছনীয় ।আমার মতে যারা জন্মদাতা বাবা এবং গর্ভধারিণী মায়ের সাথে বিট্রে করে ,তারা  ঈশ্বরের সাথে ও বিট্রে করতে পারে ।পবিত্র কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে, দেবপিতৃকার্যাভ্যাং ন প্রমদিতব্যম ।মাতৃদেবো ভব।পিতৃ দেবো ভব।আচার্যদেবো ভব ।অতিথি দেব ভব।যান্যনবদ্যানি কর্মাণি ।তানি সেবিতব্যানি ।নো ইতরাণি।যান্যস্মাকং সুচরিতানি।তানি ত্বয়োপাস্যানি।নো ইতরাণি ।অর্থাৎ দেবকার্যে ও পিতৃকার্যে অমনোযোগী হবে না; মাতা,পিতা,অতিথি এবং আচার্য যেন তোমার দেবতা হন অর্থাৎ দেবতাজ্ঞানে তাঁদের পূজা করবে ।যে সকল অনুষ্ঠান অনিন্দিত তাদের অনুষ্ঠানই তোমার কর্তব্য, নিন্দিত কর্মের অনুষ্ঠান করবে না ।আমাদের সদাচারসমূহের অনুষ্ঠানই তোমার কর্তব্য, যা অসৎকর্ম তথা সদাচার নহে তার অনুষ্ঠান করবে না ।( প্রথম অধ্যায়, একাদশ অনুবাক, দুই নং মন্ত্র) এখানে দেবতার কার্য ( যজ্ঞাদি)এবং পিতৃকার্য( তর্পণাদি কর্ম) অবহিত হয়ে নিয়মমতো সম্পাদন করার কথা ও,মাতা, পিতা,আচার্য এবং অতিথিকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করার কথা বলা হয়েছে ।লোকসমাজে যে সকল কর্ম নিন্দনীয় বলে বিবেচিত হয়,সেগুলো না করার কথা এবং আচার্যগণের শোভন আচরণ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে ।


তাহলে পবিত্র বেদের আলোকে দেবতার পূজা এবং মা বাবা,অতিথি সেবার কথা এবং আচার্যগণকে অনুসরণ করার কথা বলা থাকলেও কোন শাস্ত্রের আলোকে কেউ কেউ স্ববিরোধী কথা বলে থাকেন তা আজকের জিজ্ঞাস্য ।আর সরলমনা পাঠকরা জেনে শুনে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস রহিল । তবে যারা দেবতা পূজা এবং মা বাবার সেবা ও অতিথি সেবা শাস্ত্র বহির্ভূত মনে করেন এবং মহাজনদের পথ অনুসরণ করতে বাধা দেন তাদের ফাঁদে না পড়ার জন্য নিজে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করুন এবং সঠিক পথ খুঁজে বের করুন ।যাহোক, প্রত্যেক মত ও পথে সত্যনিষ্ঠ,আদর্শবাদী লোক আছেন যারা প্রশংসার যোগ্য ।যারা জেনে শুনে অথবা অজ্ঞতাবশতঃ মানুষকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করার করার চেষ্টা করে কেবল নিজেদের দল ভারী করতে চান তাদের থেকে সতর্ক হওয়ার জন্যই আমার লেখনী ধারণ ।মনের অজান্তে ভাষাগত দৈন্যতা ও শব্দ চয়নগত ত্রুটি বিচ্যুতিজনিত কারণে কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী ।
আধুনিক_যুগে সনাতন_জাতির_প্রথম_সংগঠক
বিভিন্ন মত এবং পথে শতধা বিভক্ত সনাতন হিন্দু ধর্মকে রক্ষার জন্য
যুগে যুগে বিভিন্ন মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে। সনাতন ধর্ম শাশ্বত এবং
ঈশ্বর প্রবর্তিত পরমমুক্তির পথ। চিরকালই এ ধর্ম ছিল, আছে এবং
থাকবে; এর কোন বিনাশ নেই কারণ ঈশ্বর স্বয়ং এ ধর্মের প্রবর্তক এবং
রক্ষাকর্তা। তাইতো যুগে যুগে এ ধর্ম কখনো সঙ্কুচিত অথবা কখনো
প্রসারিত অবস্থায় থাকে। এমনি এক সঙ্কুচিত ঘোর দুর্দিনে ভগবানের
দিব্য ঐশ্বর্যের কিঞ্চিৎ কণা নিয়ে আমাদের মাঝে আসেন এবং
আলোর পথ দেখান শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য। তাঁর জন্ম ৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দের
(মতান্তরে ৭৮৮ খ্রি.) ১২ বৈশাখ শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে কেরালা
প্রদেশের ‘কালাডি’ নামক একটি ছোট্ট গ্রামে। পিতা শিবগুরু এবং
মাতা বিশিষ্টা দেবী।
জন্ম থেকেই অসাধারণ মেধা, প্রজ্ঞা এবং ধীশক্তির অধিকারী
ছিলেন আচার্য শঙ্কর। মাত্র তিন বছর বয়সেই তিনি তাঁর মাতৃভাষা
মালয়ালাম পড়া-লেখার দক্ষতা অর্জন করেন। এর ধারাবাহিকতায়
তাঁর বয়স যখন সাত বছর তখন তিনি বেদবেদান্তসহ বিভিন্ন
ধর্মশাস্ত্রে এবং ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি
ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন পরক্ষণেই তার অবিকল বলে দিতে
পারতেন।
সনাতন সত্য ধর্মের বিজয় পতাকা দিকে দিকে উড্ডীন করার জন্যে
আচার্য শ্রীশঙ্কর হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে
বেড়িয়েছেন। পূর্বে কামরূপ (আসাম), ঢবাক (ঢাকা) থেকে পশ্চিমে
গান্ধার (আফগানিস্তান) এবং দক্ষিণে তামিলনাডু থেকে উত্তরে
তিব্বত সর্বত্র তিনি প্রচার করে বেড়িয়েছেন বৈদিক ধর্মদর্শন।
বৈদিক সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত এবং
ঈশ্বরই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্রুবতারা।
সম্রাট অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজকোষ শূন্য করে দিয়ে বৌদ্ধমত
প্রচারের নেশায় পাগলপ্রায় হয়ে যান। তিনি যুবসমাজকে কর্মবিমুখ
সন্ন্যাসের পথে প্রোৎসাহিত করেন। তিনি সৈন্যবলকে অসার ধর্মবলে
রূপান্তরিত করেন। এর ফলে ভারতবর্ষের বিদেশী শক্তির প্রতিরোধ
ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং ভারতবর্ষ পরিণত হয় দুর্বলচিত্ত ক্লীবের
দেশে। ভারতবর্ষের সাথে যুগপৎ সনাতন বৈদিক ধর্মেরও এক
মহাসন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়। ভগবান বুদ্ধের প্রয়াণের কয়েকটি
শতাব্দীকাল পরে বৌদ্ধমত বিভিন্ন সম্প্রদায়ে এবং বিভিন্ন
তান্ত্রিকপন্থায় বিভক্ত হয়ে বিকৃতি লাভ করে। সেই বিকৃতি কিছুকিছু
ক্ষেত্রে ভয়ংকর অশ্লীল কামাচারে পর্যবসিত হয়ে পরে। সেই
বৌদ্ধমত এদেশবাসীকে এমনভাবে গ্রাস করে যে, বৈদিক ধর্মের
প্রাণকেন্দ্র কাশী (বেনারস, উত্তর প্রদেশ) পর্যন্ত নাস্তিক কুরুচিপূর্ণ
মতে ম্রিয়মান হয়ে যায়। জনশ্রুতি আছে কাশী তখন পূজার অভাবে
গোচারণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এমনি এক বীভৎস সময়ে ধূমকেতুর মত
আচার্য শঙ্করের আবির্ভাব। তিনি বিভিন্ন নাস্তিক এবং অবৈদিক
অপসম্প্রদায়গুলোকে স্তব্ধ করে দিয়ে সত্য সনাতনের চিরন্তন পথে
আমাদের প্রবুদ্ধ করেন।
সনাতন ধর্ম পঞ্চমতে ও পথে বিভক্ত- সৌর, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য এবং
বৈষ্ণব। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ পঞ্চ
মতাবলম্বীরা নিজেদের মাঝে সর্বদাই সাম্প্রদায়িক কলহে লিপ্ত
থাকত। এ গুরুতর সমস্যা সমাধানে অগ্রনায়ক হলেন আচার্য শ্রীশঙ্কর।
তিনিই প্রথম সর্বজনীন উপাসনা পদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং সব
দেবতার পূজার আগে পঞ্চমতের প্রতিনিধিত্বকারী পঞ্চদেবতার (সূর্য,
শক্তি, শিব, গণেশ, বিষ্ণু) পূজার বিধান দান করেন। এ বিধান
প্রাচীনকালেও ছিল কিন্তু মাঝে অবলুপ্ত হয়ে যায়। আচার্য পুনঃ এ
বিধান সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। ফলে সর্বপ্রকার
সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃঘাতী হিংসা-হানাহানী বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে আমাদের পূজায় ব্যবহৃত অধিকাংশ পদ্ধতিই তাঁর
নির্দেশিত।
আধুনিক হিন্দু জাতিকে প্রথম একটি সাংগঠনিক রূপ দেন শ্রীপাদ্
শঙ্করাচার্য। তিনিই প্রথম সনাতন ধর্ম রক্ষায় সংঘের পূর্ণাঙ্গ ধারণা
দেন। অবশ্য সংঘের ধারণা প্রাচীনকাল থেকে ছিল কিন্তু তা ছিল
বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণাঙ্গ এবং প্রয়োগহীন। তাঁর প্রবর্তিত সংঘই ধর্ম রক্ষায়
একটি শক্তিশালী।
প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এ প্রতিষ্ঠানই ‘শঙ্কর মঠ’ নামে আমাদের
কাছে পরিচিত। ‘শঙ্কর মঠ’ কোন একক কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পরিবর্তে
ভারতবর্ষের চারপ্রান্ত থেকে চারটি মঠের দ্বারা পরিচালিত হতে
থাকে। এ চারটি মঠ ছিল সনাতন ধর্ম রক্ষায় চারটি দুর্গের ন্যায়। সিন্ধু,
সৌবীর, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমাঞ্চলের জন্য শারদা মঠ; অঙ্গ, বঙ্গ,
কলিঙ্গ, মগধ, উৎকল, গৌড়, সুক্ষ্ম, পৌণ্ড্র, ব্রহ্মপুত্র তীরবাসীসহ সমগ্র
পূর্বাঞ্চলের জন্য গোবর্দ্ধন মঠ; কুরুক্ষেত্র, কাশ্মীর, কম্বোজসহ সমগ্র
উত্তরাঞ্চলের জন্য জ্যোতি মঠ এবং অন্ধ্র, দ্রাবিড়, কর্ণাট, কেরল
প্রভৃতি দক্ষিণাঞ্চলের জন্য শৃঙ্গেরী মঠ। শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য এ চার
মঠের আচার্য হিসেবে নিযুক্ত করেন তাঁর শ্রেষ্ঠতম চার শিষ্যকে
সুরেশ্বর, পদ্মপাদ, তোটক এবং হস্তামলক। এ চার আচার্য চার মঠ থেকে
চার বেদের পূর্ণাঙ্গ বৈদিক জীবন বিধানের শিক্ষা দিতে থাকেন
দিকে দিকে। ফলে সনাতন ধর্ম একটি সুদৃঢ সাংগঠনিক রূপ পায়।
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য অধ্যাত্ম পথের পথিক এবং সাধারণ গৃহীদের
মাঝে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য চার মঠের অন্তর্ভূক্ত একদল সন্ন্যাসী
সম্প্রদায়ের প্রবর্তন করেন যারা ‘ # দশনামী_সন্ন্যাসী ’ সম্প্রদায়
নামে খ্যাত। ফলে ভারতবর্ষে তৈরি হয় শক্তিশালী এক সন্ন্যাসী
সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের অধিকাংশ ধর্মীয় মত, পথের সংগঠন এ চারমঠ
এবং দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের সাথে কোন না কোনভাবে যুক্ত।
সন্ন্যাসীর আত্মপরিচয় এই পর্যায়ে স্বামী বিবেকানন্দের বিবরণ
থেকে জানা যায় ‘শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ’ শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের শৃঙ্গেরী
মঠের অধিভূক্ত একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের
প্রাণপুরুষ শ্রীগৌরাঙ্গদেব দুজন গুরুর কাছে মন্ত্রদীক্ষা এবং সন্ন্যাস
নিয়েছিলেন; তাঁরা হলেন শ্রীঈশ্বরপুরী এবং শ্রীকেশব ভারতী।
তাঁরা দুজনেই শৃঙ্গেরী মঠভূক্ত সন্ন্যাসী। এমনকি যে নামে
শ্রীগৌরাঙ্গদেব আমাদের মাঝে খ্যাত ‘শ্রীচৈতন্য’; এই ‘চৈতন্য’
নামটি শৃঙ্গেরীমঠভূক্ত ব্রহ্মচারী উপাধি। অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যও
শঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পরম্পরাগত সন্ন্যাসী।
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই দশপ্রকার দশনামী
# সন্ন্যাসীদের_সনাতন_ধর্মপ্রচারে আলস্য ত্যাগ করে সদা সক্রিয়
থাকার আদেশ দিয়েছেন তাঁর তৈরি মঠানুশাসনে। সেখানে
ধর্মরক্ষার্থে তাঁর সকল সাঙ্গঠনিক রূপরেখা পাওয়া যায়। সেখান
থেকে দুটি শ্লোক উল্লেখ করছি:
যত বিনষ্টির্মহতী ধর্মস্যাত্র প্রজায়তে।
মান্দ্যং সন্ত্যাজ্যমেবাত্র দাক্ষ্যমেব সমাশ্রয়েৎ।।
ন জাতু মঠমুচ্ছিদ্যাদধিকারিণ্যুপস্থিতে।
বিঘ্নানামপি বাহুল্যাদেষ ধর্ম সনাতনঃ।।
(মঠানুশাসনম্ : ৫, ১১)
"হে আমার সন্ন্যাসীবৃন্দ ( দশনামী), এই সময়ে ধর্মের মহতী হানি
হয়েছে, তাই এই সময়ে সন্ন্যাসীদের ধর্মপ্রচারে মন্থরতা অবশ্য
পরিত্যাজ্য। ধর্মপ্রচারে সর্বদা দক্ষতার আশ্রয় করবে অর্থাৎ আলস্য
ত্যাগ করে ধর্মপ্রচারে সদা তৎপর হবে।
হে সন্ন্যাসীবৃন্দ তোমাদের বলছি, ধর্মপ্রচারে বিঘ্ন যতই অধিক হোক,
উপযুক্ত অধিকারী, যথোক্ত গুণসম্পন্ন আচার্য থাকলে, কেউ কখনও আমার
মঠ উচ্ছেদ করতে পারবে না। যেহেতু আমাদের ধর্মই সনাতন। অর্থাৎ
উপযুক্ত উপদেশকেই সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মের প্রচারে উপযুক্ত
উপদেশকের অভাব হইলে সেই মঠ অকর্মণ্য।"
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য তাঁর বত্রিশ বছরের সামান্য আয়ুতে অসংখ্য গ্রন্থ
রচনা করেছেন। তাঁর রচিত এখনো পর্যন্ত # ১৫১_খানা_গ্রন্থের সন্ধান
পাওয়া যায়। এর মধ্যে বেদ এবং বেদান্ত দর্শনের ভাষ্য গ্রন্থের উপর ২২
খানা। এ ২২ খানা ভাষ্যগ্রন্থের মধ্যে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে
ধরা হয় ‘ব্রহ্মসূত্র’ ভাষ্য’কে। এ সূত্র ভাষ্যতেই তিনি তাঁর দার্শনিক
তত্ত্বকে সুদৃঢ় ভিত্তিমূলে প্রতিস্থাপিত করেন। আত্মতত্ত্ব এবং প্রকৃত
বৈদিক জীবন লাভের জন্য দিক-নির্দেশনামূলক আদেশ, উপদেশ এবং
প্রকরণ গ্রন্থের সংখ্যা ৫৪ খানা। দেবদেবীদের স্তবস্তুতিমূলক গ্রন্থ ৭৫
খানা। প্রচলিত অধিকাংশ স্তব স্তুতিই এ গ্রন্থগুলি থেকে নেয়া।
অসাধারণ তার ধ্বনিমাধুর্য এবং অসাধারণ তার পদলালিত্য।
আচার্যের জীবনের একটি প্রধান কীর্তি হল শ্রেষ্ঠ পবিত্র
মন্দিরগুলোতে ভগবদ্বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা। জগন্নাথ ধামে কালযবনের
অত্যাচারকালে মন্দিরের সেবায়েত পাণ্ডাগণ জগন্নাথ বিগ্রহের উদর
প্রদেশ স্থিত রত্নপেটিকা চিল্কা হ্রদের তীরে ভূগর্ভে লুকিয়ে
রাখেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালক্রমে উক্ত স্থানের লোকেরা ভুলে
যান রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে। আচার্য শ্রীশঙ্কর যোগবলে
জগন্নাথের রত্নপেটিকা রাখার স্থানটিকে নির্ধারণ করে দেন এবং
পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। বদরিকাশ্রমে নারায়ণ বিগ্রহও তিনি
অনুরূপভাবে প্রকাশিত করেন।
আচার্য শ্রীশঙ্কর ছিলেন যুক্তিবাদিতার এক অত্যুজ্জ্বল বিগ্রহ। তিনি
যুক্তি বিহীন কোন কথা বলতেন না। যে কথাই বলতেন তার পিছনে
থাকতো তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি। সে অকাট্য যুক্তির জাল ছিন্ন করা ছিল
দুঃসাধ্য। কারণ তিনি ছিলেন সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই তিনি যা
বলেছেন তাই সত্যে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি বৈদিক ধর্মের
পুনরুত্থান ঘটালেন শুধুমাত্র যুক্তি, মেধা, প্রজ্ঞার সহায়তায়। না কোন
রক্তপাত না কোন হানাহানি, না কোন রাজশক্তির ক্ষমতার
অপপ্রয়োগে। কোন কিছুই ধ্বংস করেন নি, করেছেন সৃষ্টি, পুনঃপ্রবর্তন।
বশিষ্ট-ব্যাসের ন্যায় মেধা প্রজ্ঞার সাথে অসাধারণ সারল্য, লাবণ্য
ছিল তাঁর সারা দেহে, তাই তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ না হয়ে
উপায় ছিল না।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের কথা ভাবলে
গা রোমাঞ্চিত হয়, ভাবি শ্রীশঙ্করাচার্য কি একজন, না শত সহস্রজন!
মাত্র বত্রিশ বছর, মহাকালের কাছে কতটুকু সময়! এ সময়ের মধ্যে একজন
ব্যক্তি এত অসাধারণ কীর্তি কি করে করলেন; এই সামান্য সময়ের মধ্যে
কিভাবে তিনি এত জনপদে ঘুরে বেরিয়েছেন; কি কৌশল অবলম্বন করে
কোটি কোটি মানুষকে সনাতন ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে
এসেছেন; এত ব্যস্ততার মধ্যেও কিভাবে তিনি ১৫১টা অমূল্য গ্রন্থের
রচনা করেছেন; এবং এত সুসংবদ্ধ, অনন্য, অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা
তিনি কোথায় পেলেন?
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের সমতুল্য ব্যক্তি ভারতবর্ষে তো বটেই পৃথিবীর
ইতিহাসে বিরল। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের
যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারিনি। আচার্যের জীবনে আমরা দেখি যা
কিছু সনাতন ধর্মের সমৃদ্ধিবাচক কাজ হয়েছে তা তাঁর জীবৎকালেই
হয়েছে। তাঁর অন্তর্ধানের পর ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং
যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে চারমঠ আচার্যের জীবৎকালের ন্যায় নেতৃত্ব
দিতে ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতার কারণেই অনন্য অসাধারণ কাজের পরেও
আচার্য শ্রী শঙ্করকে আমরা ভুলতে বসেছি। আজ শ্রীপাদ্
শঙ্করাচার্যের উক্তি বিভিন্ন গুরু এবং গুরুরূপী ভগবানগণ (!) নিজেদের
নামে চালিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। কারণ এ গুরু ব্যবসা করা
কুম্ভীলকদের ধরবে কে? এর জন্য আমরাও কম দায়ী নয়। যতদিন যাচ্ছে
তত বেশি করে আমরা মূলবৃক্ষকে ছেড়ে শাখা প্রশাখায় যেয়ে বসছি
এবং তাকেই মূলবৃক্ষ বলে অভিমান করছি। সনাতন বৈদিক রাজপথ ছেড়ে
কতগুলো অপরিচ্ছন্ন অলিগলিতে যেয়ে পথহারা পথিক হয়ে বসে আছি।
অলিগলিতে চলতে চলতে আমরা টেরও পাচ্ছি না যে আমরা প হাইব্রীড ফসলে সারা দেশ ছেয়ে যাচ্ছে।
ভণ্ডদের কারণে  অসংখ্য মত পথের জঞ্জালে আমাদের যুবকসমাজ
পথহারা, ভ্রান্ত, বিপথগামী হয়ে সনাতন ধর্ম, সমাজ এবং
পারিবারিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে।
পরিণামে কেউ হচ্ছে মানসিক হীনমন্য, কেউ বেছে নিচ্ছে ধর্মান্তর,
কেউবা হয়ে যাচ্ছে ঘোরতর নাস্তিক।
দক্ষিণভারতের একটি দ্রাবিড় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয়ায়
জন্মগতভাবে শঙ্করাচার্যের মধ্যে জাতিবর্ণভেদের সংস্কারটি
ছিল। শিক্ষা দেন সকল জীবজগৎ আদতে একই ব্রহ্মের রূপ থেকে
রূপান্তর মাত্র ; অর্থাৎ প্রত্যেকটি জীবের মাঝেই একই ব্রহ্ম
বিরাজ, এই অখিল ব্রহ্মাণ্ড চিন্মাত্ররূপে বিস্তৃত, আমা কর্তৃক
ত্রিগুণময়ী অবিদ্যা দ্বারা এ অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড কল্পিত হয়েছে, যে
ব্যক্তির এইপ্রকার দৃঢ বুদ্ধি সুখময় নির্মল ব্রহ্মে অটলা থাকে
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য কিভাবে সকল মানবকুল নির্বিশেষে কেমন
# একটি_ঐক্যবদ্ধ_বৈশ্বিকজাতির_কল্পনা করেছেন তার একটি অনন্য
উদাহরণ পাওয়া যায় তাঁর রচিত 'অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্' নামক গ্রন্থে। এ
স্তোত্রের শেষ শ্লোকে তিনি উদাত্তস্বরে বলেছেন, তাঁর মা হলেন
জগতের জননী পার্বতী এবং পিতা হলেন জগতের পিতা মহেশ্বর, আর
জগতের জনকজননীর সন্তান সকল অর্থাৎ জীবসকল হলো পরমবন্ধু ; স্বর্গ,
মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই হলো তাঁর স্বদেশ।
মাতা মে পার্ব্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ ।
বান্ধবাঃ শিবভক্তাশ্চ স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্ ।।
(অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্ :১২)
জগতের মাতা ভগবতী পার্বতী হলেন আমার মা এবং জগতের পিতা
দেব মহেশ্বর হলেন আমার পিতা ; আমার পরম বান্ধব হলেন জগতের
পিতামাতার ভক্তগণ এবং স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই আমার
স্বদেশ।
আজ নিমজ্জমান হিন্দু জাতিকে রক্ষার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের ন্যায় তেজদীপ্ত নায়ক, সংগঠক, ব্রহ্মবাদী
এবং ঈশ্বরে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী মহামানবের। সেই পারবে হিন্দু
সমাজের অনাকাঙ্ক্ষিত জঞ্জালকে বিদূরিত করে এক ঐক্যবদ্ধ সুসংবদ্ধ
জাতিতে
পরিণত করতে। তাই সেই নতুন এক সূর্যোদয়ের আকাঙ্ক্ষী হয়ে, সেই
মহামানবের প্রতীক্ষায় আছি আমরা সকলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ভাষায়-
ওই মহামানব আসে,
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে॥
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক-
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয়শিখরে জাগে ‘মাভৈঃ মাভৈঃ’
নবজীবনের আশ্বাসে।
সনাতন ধর্মকে নিয়ে অহেতুক সমালোচনা কাম্য নয়,
ইসলাম ধর্মের লোকদের মাঝে কেউ কেউ সনাতন ধর্মের ঈশ্বরের একত্ববাদ এবং মূর্তি পূজা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ।কেউ কেউ হিন্দু ধর্ম কোন ধর্ম নয়, স্রষ্টার একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম এবং পবিত্র কোরআন নাযিল হওয়ার পর অন্য ধর্মগ্রন্থ বাতিল এবং ইসলাম ধর্ম নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী,সনাতনধর্মের লোক  নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয় বলে থাকেন ।এতদবিষয়ে সনাতন ধর্মের লোকদের মাঝে সন্দেহের বা খটকার সৃষ্টি করা হয় ।আমি সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ পবিত্র বেদের আলোকে আলোচনায় ব্রতী হলাম ।সনাতন ধর্মের মহাবাক্য, একমেবাদ্বিতীয়ম (ছান্দোগ্য উপনিষদ-৬|২|১)। ঋকবেদে বলা হয়েছে, একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি (১|১৬৪|৪৬)। অর্থাৎ সদ্বস্তু এক,বিপ্ররা বহু নামে অভিহিত করে থাকেন ।সুতরাং, পবিত্র বেদ নিখুঁত একত্ববাদের ধারক।ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে, একং ব্রহ্ম, দ্বৈত নাস্তি নাহিনা নাস্তি,কিঞ্চন ।অর্থাৎ, ব্রহ্ম বা পরমেশ্বর এক, তার মতো কেউ নেই, কেউ নেই, সামান্য ও নেই ।কেউ কেউ ব্রহ্ম আর ব্রহ্মাকে এক করে ফেলেন ।ব্রহ্ম হলেন স্রষ্টা এবং ব্রহ্মা হলেন ব্রহ্মের সৃষ্ট ।ব্রহ্মার স্ত্রীলিঙ্গ ব্রহ্মাণী আছে ।ব্রহ্মের কোন লিঙ্গান্তর নেই ।ব্রহ্মের স্বরূপ ওঁ যার কোন লিঙ্গান্তর বা বচনান্তর নেই ।সনাতন ধর্মে র লোক বহুদেবতাবাদী, বহু ঈশ্বরবাদী নন ।ঈশ্বর ও দেবতা এক নন।দেবতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের এক একটি গুণের প্রতীক বা শক্তি ।আর সনাতন ধর্মের লোক মূর্তি পূজা করেন না,মূর্তিতে ঈশ্বর বা দেবতার পূজা করে থাকেন ।যদি মূর্তিকে ঈশ্বর ভেবে পূজা করা হতো, তাহলে পূজার পর মূর্তিকে বিসর্জন না দিয়ে বা গাছ তলায় না রেখে ঘরেই রাখা হতো ।দেবতা পূজা করে ঈশ্বরের সাথে অংশীদারিত্ব করা হয় সে ধারণা সঠিক নয় ।ঈশ্বর নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা ,আর দেবতারা ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ।ঈশ্বর এক একটি কর্মভার একেকজন দেবতার উপর অর্পণ করেন ।সকল দেবতার পূজা সমাপন করে বিষ্ণুর নামে সমর্পণ করা হয় ।ঈশ্বর সর্বব্যাপী বলে ঈশ্বরের গুণবাচক নাম বিষ্ণু ।সনাতন ধর্মের লোক পৌত্তলিক নয়,প্রতিমা পূজক ।ইসলাম ধর্ম প্রচারের আগে আরববাসী পৌত্তলিক ছিল ।তাদের পূজিত দেবতার সাথে সনাতন ধর্মের দেবতার কোন মিল নেই ।সনাতন ধর্মের দেবতা কালী, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী দেবতার নামে কোন দেবতা আরববাসীর ছিল না ।আরববাসীর লোকদের নামের সাথে সনাতন ধর্মের লোকদের নামের কোন মিল নেই ।আবু তালেব, আব্দুল মোতালেব, ওসমান, আলী,আবুবকর( রাঃ),আমেনা, ইত্যাদি নাম সনাতন ধর্মের লোকদের নেই ।।কাজেই  ,পৌত্তলিক আরববাসীকে সনাতন ধর্মের লোক বলে অভিহিত করা যথাযথ নয়। হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ) এর নির্যাতনকারী সীমার ও এজিদ এর নাম সনাতন ধর্মে নেই ।হিন্দু ধর্ম একটি ধর্ম নয়,সেই সমালোচনার বিরূপ সমালোচনা না করে বলছি ,হিন্দুধর্ম কোন ধর্ম নয়, আমাদের ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম ।সনাতন মানে শাশ্বত ও চিরন্তন ।হিন্দু একটি সম্প্রদায় যারা সনাতনী নামে পরিচিত ।হিন্দু তথা সনাতনীদের ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম ।যেমন মুসলমান একটি সম্প্রদায় এবং তাদের ধর্মের নাম ইসলাম ধর্ম ।ইসলাম ধর্মের লোকদের কেউ কেউ বলে থাকেন, কোরআন নাযিল হওয়ার পর অন্য ধর্ম গ্রন্থ বাতিল হয়ে গিয়েছে ।আমার মতে, সনাতন ধর্ম যেহেতু ইসলাম ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়,কাজেই তাদের ধর্ম গ্রন্থ নাযিল হওয়ার পর সনাতন ধর্মের ধর্ম গ্রন্থ বাতিল হওয়ার প্রশ্ন উঠে না ।ইসলাম ধর্মের মোট একশত চারখানা আসমানী কিতাব এবং প্রধান আসমানী কিতাব চারখানা ।একশত আসমানী কিতাবের মধ্যে সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদসহ কোন ধর্ম গ্রন্থ থাকার কথা নয় ।কাজেই, বাতিল হওয়ার প্রশ্ন কী যুক্তিযুক্ত? ইহুদি ও খ্রিস্টান আহেলে ইসলাম বা আহেলে কিতাব ।আহলে কিতাব হলো প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের অনুসারী ।তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরীত ও ইঞ্জিল বিকৃত হয়ে থাকলে তারা তা বাতিলের দাবি করতে পারেন, সনাতন ধর্মের কোনো ধর্ম গ্রন্থ নয় ।সনাতন ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের কোনো বিরোধ নেই, সর্ব ক্ষেত্রে মিল ও  নেই ।স্ব স্ব ধর্মের লোকের কাছে স্ব স্ব ধর্ম শ্রেষ্ঠ ধর্ম ।কোনো ব্যক্তিকে সমালোচনা করা যায়, কোন ধর্মকে সমালোচনা করা সৃষ্টির সেরা মানবজাতির ধর্ম নয় ।সনাতন ধর্মের কোনো প্রবর্তক নেই, স্বয়ং ঈশ্বর সেই ধর্মের স্রষ্টা ।বেদের ঋষিগণ প্রধান ধর্ম গ্রন্থ বেদের দ্রষ্টা।বেদ ঈশ্বরের বাণী ।তাই, বেদ বাতিলের প্রশ্নই উঠে না ।পবিত্র বেদে ঈশ্বর নিরাকার ।তবে, দ্রষ্টা ঋষিগণ কর্তৃক বেদের কোন জায়গায় ঈশ্বরের সাকার রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় । যজুর্বেদে বলা হয়েছে, তিনি ( পরমাত্মা) সর্ব ব্যাপক, সর্ব শক্তিমান, শরীর রহিত,রোগ রহিত, জন্ম রহিত, শুদ্ধ,নিষ্পাপ,      সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, দুষ্টের দমনকর্তা ও অনাদি।তিনি তাঁর শাশ্বত প্রজা জীবের জন্য যথাযথ ফলের বিধান করেন(৪০|৮)।, এখানে ঈশ্বরের নিরাকারত্ব বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে ।ঋকবেদে আরো বলা হয়েছে, পুরুষের অনন্ত মস্তক, অনন্ত নয়ন,অনন্ত চরণ।তিনি বিশ্ব জগতকে- সর্বতোভাবে পরিব্যাপ্ত করে ও জীবদেহে নাভির দশাঙ্গুল উর্দ্ধে হৃদয়মধ্যে অবস্থিত আছেন ১০|৯০|১)।এখানে কিছুটা সাকার রূপের ইংগিত পেলেও পরোক্ষভাবে নিরাকারত্ব প্রকাশ পেয়েছে ।বলা হয়েছে, ন তস্য প্রতিমা অস্তি যস্য নাম মহদ যশঃ ।অর্থাৎ, তার কোনো প্রতিমা নেই যাঁর নাম মহৎ যশ আছে ( যজুর্বেদ-৩২|৩)।কেউ কেউ প্রতিমা শব্দকে প্রতিম হিসেবে ধরে নিয়ে তাঁর তুলনা নেই বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ।যাহোক ঈশ্বরের সাকার নিরাকার উভয় ব্যাখ্যা থাকলেও ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয় নাই ।তাই সনাতন ধর্মের লোকের ঈশ্বরকে সাকার নিরাকার বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে মাইনাস করার সুযোগ নেই ।সনাতন ধর্মাবলম্বী ভাই গিরিশচন্দ্র সেন সর্ব প্রথম কোরান শরীফ বাংলা  ভাষায় অনুবাদ করেন ।সনাতন ধর্মে যদি সারবত্তা না থাকতো অথবা সনাতন ধর্ম কোনো ধর্ম না হতো, তাহলে তিনি অবশ্যই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতেন ।সনাতন ধর্ম আদি ধর্ম।সনাতন ধর্ম শাশ্বত ও চিরন্তন যার নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে ।সনাতন ধর্মের কোনো ধর্ম সভায় অন্য ধর্মের সমালোচনা করা হয় না ।নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে অন্য ধর্মের সমালোচনা ঠিক নয় ।কোনো ধর্ম সম্পর্কে জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে সমালোচনা করা প্রকৃত ধার্মিকের পরিচয় নয়।সনাতন ধর্ম এমন একটি ধর্ম যা সব সময় শুধু সনাতন ধর্মের লোকদের জন্য নয়,সারা বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনা করে ।জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সনাতন ধর্মের ধর্মগ্রন্থের আলোকে অনেক কবিতা,গান ও শ্যামা সংগীত লিখেছেন ।তিনি ইসলাম ধর্মের গজল লিখার পাশাপাশি সনাতন ধর্ম নিয়ে লিখতে ভুল করেননি ।যাহোক, সনাতন ধর্মের মতো কিছু সংখ্যক প্রজ্ঞাবান উদারপন্থী লোকও ইসলাম ধর্মে রয়েছেন যারা অন্য ধর্মের সমালোচনা করেন না ।তাদের কাছে সবিনয়ে অনুরোধ, তারা যেন সনাতন ধর্মের সমালোচনাকারীদেরকে প্রজ্ঞার বলে বুঝিয়ে সনাতন ধর্মকে অহেতুক সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা করেন । ।কাউকে আঘাত করার জন্য আমার লিখার উদ্দেশ্য নয়, অকারণে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ও সনাতন ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনার নিরসনের ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র ।আমার সতীর্থ সনাতনী ভাইবোনদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আমার লিখার সহমত পোষণ করতে যেয়ে ইসলাম ধর্মকে আঘাত না করে মন্তব্য করবেন।পরিশেষে বলি,সনাতন ধর্মকে নিয়ে অহেতুক সমালোচনা কাম্য নয় । ।আমার লিখাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দর্শন করার বাসনা রইলো । আমার লিখার ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থী ।

চার বর্ণের অশৌচ বিভ্রান্তির সমাধান

চার বর্ণের অশৌচ নিয়ে আজও বিভ্রান্তির শেষ নেই ।আজকাল কেউ কেউ সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ পালনের পক্ষপাতী ।এর সমর্থনে গরুড় পুরাণের পূর্ব খণ্ডের ৬|১০ও ৬|৪০নং এবং মনুসংহিতার ৫|৫৯নং শ্লোকের উদ্ধৃতি দেন।বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সপিণ্ডদিগের মরণাশৌচ দশাহ; যারা নিপূণভাবে শুদ্ধি আকাঙ্ক্ষা করেন তারা পুত্রাদি  জননে ও দশাহাশৌচ পালন করেন (৬|১০)আরো বলা হয়েছে,শ্রীকৃষ্ণ বলেন,  যে প্রেতের উদ্দেশ্য একাদশ দিনে বৃষোৎসর্গ না হয়,তার উদ্দেশ্য শত শত শ্রাদ্ধ করলে ও প্রেতত্ব বিমুক্ত হয় না ৬|৪০)।এখানে বক্তা শ্রীবিষ্ণু এবং শ্রোতা ব্রাহ্মণ কশ্যপ মুনির সন্তান বিষ্ণুভক্ত গরুড় ।উল্লেখ্য,গরুড় পুরাণে উল্লিখিত শ্রীকৃষ্ণ হলেন চতুর্ভুজা শ্রীবিষ্ণু ।কারণ, বিষ্ণুর সহস্র নামের এক নাম কৃষ্ণ ।যাহোক, তাদের ভাষায় ভগদ্বাক্য অলঙ্ঘনীয় ।আমি ও তাই বলি।এ শ্লোকগুলো কেবলমাত্র বিপ্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।কারণ উক্ত শ্লোকে' সর্বেষামেব বর্ণানাং ' অর্থাৎ সর্ববর্ণের উল্লেখ নেই ।তাছাড়া গরুড়ের জিজ্ঞাসার উত্তরে ভগবান বিষ্ণু অন্তেষ্টি ক্রিয়া থেকে শ্রাদ্ধ ক্রিয়া পর্যন্ত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, বিপ্রগণ বিধি অনুসারে সমস্ত কার্য করবেন ( উঃখঃ ৫|১৮০)। এই কথা বলার পর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১০নং শ্লোক পর্যন্ত কোন বর্ণের উল্লেখ না থাকায় তা বিপ্রদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে তা শতভাগ নিশ্চিত ।গরুড় পুরাণেই একাধিকবার চার বর্ণের ভিন্ন ভিন্ন অশৌচ বিষয়ে বলা হয়েছে ।গরুড় পুরাণের পূর্ব খণ্ডের ৫০|৮১-৮৩,১০৬|১৯,২২৬|৩৮নং শ্লোকে চার বর্ণের আলাদা আলাদা অশৌচ বর্ণনা করা হয়েছে । এবিষয়ে এখানে নিন্মে প্রদত্ত ভিডিও আলোচনাটি দেখলে আরো ক্লিয়ার হতে পারবেন, 

  
গরুড় পুরাণের পূর্ব খণ্ডের ১০৭|১০-১১নং শ্লোকে অশৌচ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ব্রহ্মবিৎ ব্রাহ্মণ প্রেতাশৌচ ও জননাশৌচ হলে তিন দিনে শুদ্ধি লাভ করবেন ।এরূপ ব্রহ্মবিৎ ক্ষত্রিয় দশ দিনে, ব্রহ্মবিৎ বৈশ্য বারদিনে এবং ঐরূপ শূদ্র ত্রিশ দিনে শুদ্ধি লাভ করবেন ।যিনি জাতি মাত্র বিপ্র তিনি দশ দিনে, জাতিমাত্রে ক্ষত্রিয় বার দিনে, জাতিমাত্র বৈশ্য পনেরো দিনে এবং জাতিমাত্র শূদ্র এক মাসে শুদ্ধ হবেন ।কাজেই, দেখা যায়, শূদ্র ব্রহ্মবিৎ হলে ও অশৌচের শিথিলতা নেই অর্থাৎ অশৌচ ত্রিশ দিন ।তাছাড়া গরুড় পুরাণের আদি বক্তা হরি বা বিষ্ণু ।তাই, সকল শ্লোক শ্রীহরি কর্তৃক সমর্থিত ।একটা জিনিস লক্ষ্য করুন, গরুড় পুরাণে শ্রীবিষ্ণুর বাচনীক বৃষোৎসর্গ না হলে শত শত শ্রাদ্ধ করলে ও প্রেতত্ব বিমুক্ত হয় না উল্লেখ থাকলেও বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করার বিষয়ে কোন বক্তব্য সভা সমিতিতে দেয়া হয়নি ।কেবল এগারো দিনে শ্রাদ্ধ প্রতিষ্ঠিত করতে উক্ত শ্লোকের উদ্ধৃতি দেয়া হয় ।বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, সপিণ্ডের জননে ও মরণে ব্রাহ্মণের অশৌচ দশাহ, ক্ষত্রিয়ের দ্বাদশাহ, বৈশ্যের পঞ্চদশাহ এবং শূদ্রের একমাস (১৩|১৯,১১/১-৩)।বিষ্ণু পুরাণের শ্লোকগুলো গরুড় পুরাণের চার বর্ণের অশৌচ বিষয়ে শ্লোকগুলোকে পূর্ণ সমর্থন করে এবং বিপ্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শ্লোকেরও সমর্থন দেয় ।মনুসংহিতার ৫|৫৯নং শ্লোকটি যে ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা ৫/৮৩নং শ্লোকের দ্বারা প্রমাণিত হয় ।সরলার্থ ও তাৎপর্যে বলা হয়েছে, সপিণ্ডের মৃত্যু হলে নির্গুণ ব্রাহ্মণের দশ দিন এবং গুণের তারতম্য অনুসারে চারদিন, তিন দিন কিংবা এক অহোরাত্র মাত্র অশৌচ হবে ।ব্রাহ্মণের বেদ জ্ঞান ও অগ্নিচর্যা বিবেচনা করে অশৌচ কালের এরকম তারতম্য হয়( ৫/৫৯)।উক্ত শ্লোকে ব্রাহ্মণ শব্দটি উল্লেখ না থাকলেও সর্ববর্ণের উল্লেখ না থাকায় ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রেই বুঝতে হবে ।১০০নং শ্লোকে বলা হয়েছে, হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠগণ! সপিণ্ডের মৃত্যুতে অন্যান্য সপিণ্ডের পক্ষে শৌচ লাভ করার যে সব বিধান আছে, তা তোমাদের বললাম ।এখন অসপিণ্ড মরণে যে রকম অশৌচ হয়, তা আপনারা এবার শুনুন।এখানে দ্বিজ শ্রেষ্ঠ বলতে ব্রাহ্মণকে বুঝানো হয়েছে ।তাছাড়া ৮৩নং শ্লোকে বলা হয়েছে, উপনীত সপিণ্ডের মরণে বা জননে ব্রাহ্মণেরা দশ দিনে শুদ্ধ হন, ক্ষত্রিয়েরা দ্বাদশ দিনে, বৈশ্যেরা পঞ্চদশ দিনে এবং শূদ্র এক মাসে শুদ্ধ হন ।৫৯নং শ্লোকে গুণের তারতম্য অনুসারে তিন দিন ও এক অহোরাত্র অশৌচের কথা বলা হয়েছে ।যে ব্রাহ্মণ সাগ্নিক ও স্বাধ্যায় পাঠে নিরত তাঁর একদিন অশৌচ হয় ।নিরগ্নি ও কেবলমাত্র স্বাধ্যায় পাঠে নিরত ব্রাহ্মণের তিন দিন এবং জাতিমাত্রে ব্রাহ্মণের দশদিন অশৌচ হয় ।একাহাচ্চুদদ্ধতে বিপ্রোহযাগ্নি বেদ সমন্বিতঃ।ত্র্যহং কেবল বেদস্তুদ্বিহীন দশভির্দ্দিনৈঃ।।কাজেই, ৫৯নং শ্লোকটি কেবল ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা প্রমাণিত ।সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ এর সমর্থনে, 'এই শ্লোকের উদ্ধৃতি  দেয়া হয়, ' সর্ব্বেষামেব বর্ণানাং সূতকে মৃতকে তথা ।দশাহাচ্ছুদ্ধিরেতষামিতি শাতাতপঃ অব্রবীৎ।।মিতাক্ষরায় উক্ত অঙ্গিরা বচন ।উক্ত শ্লোকে বুঝা যায় অঙ্গিরা ঋষি শাতাতপঃ ঋষির বরাত দিয়ে বলেছেন সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ ।এই শ্লোকটির কোন শ্লোক সংখ্যা উল্লেখ নাই।তাছাড়া অঙ্গিরা সংহিতায় বলা হয়েছে, ব্রাহ্মণ দশ দিনে শুদ্ধ হন,ক্ষত্রিয় বার দিনে, বৈশ্য এক পক্ষে  এবং শূদ্র এক মাসে শুদ্ধ হন (৫১নং শ্লোক)।অন্যত্র বলা হয়েছে, শাতাতপ ঋষি বলেছেন, ক্ষত্রিয় এগার দিনে, বৈশ্য বার দিনে এবং শূদ্র বিশ দিনে শুচি হবে ( লেখকঃ জিতেন্দ্রিয় দাসের শ্রাদ্ধ তত্ত্ব বিচার- ইসকন) উক্ত লেখক প্রাগোক্ত সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ পালনের শ্লোকটি উপহার দিয়ে সর্ববর্ণেদশাহাশৌচ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন ।কিন্তু আঙ্গিরা ও শাতাতপার আলোচ্য শ্লোক থেকে আপনারাই বিচার করুন কোনটা সঠিক হবে?ইসকন প্রকাশিত :শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুপাদ বিরচিত  ভক্তি রসামৃত গ্রন্থে অষ্টম অধ্যায়ে বর্জনীয় অপরাধ বিষয়ে বলা হয়েছে, দূষিত অবস্থায় মন্দিরে প্রবেশ করা উচিত নয় (বৈদিক শাস্ত্রের নির্দেশ অনুযায়ী পরিবারের পরিবারে কারো মৃত্যু হওয়ার পর সমস্ত পরিবারই কিছু দিনের জন্য অশুচি হয়ে যায় ।ব্রাহ্মণদের এই অশৌচ অবস্থা বারো দিন থাকে ।ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের পনেরো দিন এবং শূদ্রের জন্য ত্রিশ দিন ।তাহলে বিচার করুন,জিতেন্দ্রিয় দাসের সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাছাড়া অত্রি সংহিতার"৮৫নং,যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতার ৩|২২, উশন সংহিতার ৬|৩৪,সংবর্ত্ত সংহিতার ৩৮নং শ্লোক, পরাশর সংহিতার ৩|৪, শংখ সংহিতার১৫|২-৩,গৌতম সংহিতার চৌদ্দ অধ্যায়ে, কুর্ম পুরাণের ২৩|৩৮, পদ্ম পুরাণ,ব্রহ্ম পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, মার্কণ্ড পুরাণ, ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ,মৎস পুরাণসহ অসংখ্য পুরাণ ও সংহিতায় চার বর্ণের আলাদা আলাদা অশৌচ বর্ণনা করা হয়েছে ।এতগুলো পুরাণ ও স্মৃতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই ।তাছাড়া কেউ কেউ বার দিন, আবার কেউ পনেরো দিন অশৌচ পালন করে শ্রাদ্ধাদি কার্য করে থাকেন ।সুবিধাবাদী ব্যবস্থাপকরা ব্যবস্থা  দিয়ে থাকেন ।সর্ববর্ণে দশাহাশৌচ শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত থাকলে বারো দিন ও পনের দিনের অশৌচ পালনের সিদ্ধান্ত দিতেন না ।কেউ কেউ বলেন, বর্তমান যুগে মানুষের চাকুরি বা অন্যান্য  সমস্যার কথা বিবেচনা করে অশৌচ কমিয়ে দেন।শাস্ত্রীয় বিধান পরিবর্তন করার কী সুযোগ আছে সভা সমিতি করে ।তবে অশৌচ বিধি যদি শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত না হয়ে থাকে তাহলে তো তিন দিনে বা একদিনে শ্রাদ্ধ করা যায় ।আর শূদ্রের শ্রাদ্ধে ব্রাহ্মণ না আনলেও তো হয় ।মনু বলেছেন, স্ত্রী ও শূদ্র অমন্ত্রক শ্রাদ্ধ করতে পারবে ।ব্রাহ্মণের ব্যবসায় হাত দিলাম ।একথা বললাম এজন্য, আজও ব্রাহ্মণরাই তো কেউ কেউ অশৌচ থাকতে, কেউ অশৌচান্তে শ্রাদ্ধ ক্রিয়া করাচ্ছেন ।সকল ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয়ভাবেএক মতে নিজের ও যজমানের মঙ্গলের কথা ভাবেন, ইহকাল ও পরকালের কথা ভাবেন ।আমি কাউকে উপদেশ দিচ্ছিনা ।উপদেশ দেবার মতো ক্ষমতা ও আমার নেই ।সমাজের দায় বদ্ধতা থেকেলও ফেইসবুক বন্ধুদের প্রশ্নের আলোকে আমার লিখা ।বর্তমান যুগের পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে অশৌচ কমানোর বিষয়ে মত প্রকাশ করতে প্রবল ইচ্ছে থাকলে ও শাস্ত্র পাঠ করে শাস্ত্রের বাহিরে সিদ্ধান্ত দিতে বিবেক বাধা দেয় ।যাহোক, শাস্ত্রের আলোকে বলি ,ব্রাহ্মণদের অশৌচ দশদিন, ক্ষত্রিয়র বার দিন, বৈশ্যের পনেরো দিন এবং শূদ্রের একমাস ।আর শাস্ত্রের আলোকে সিদ্ধান্ত নেবার ভার আপনাদের সর্বোচ্চ আদালত বিবেকের উপর ছেড়ে দিলাম ।সুদীর্ঘ লিখায় ভুল ভ্রান্তি র জন্য ক্ষমা প্রার্থী ।
 অশৌচের প্রয়োজনীতা কি?  শাস্ত্রীয় কিছু দিকনির্দেশ, 
স্মৃতোক্ত অশৌচ বিধি, অপূর্ব্ববিধির অন্তর্গত। বৈদিক সদাচারে স্মরণাতীত কাল হইতে, সনাতন সমাজে এই বিধি মর্য্যাদার সাথে আচরিত হয়। অপূর্ব্বতা বলেই, এই বিধি প্রশ্নাতীত-সংশয়াতীত মান্যতায় অঙ্গীকৃত। অন্যথায়, বিধির প্রযোজক কারন স্বীকৃত হলে, অপূর্ব্বতার হানি হয়। ইহা শাস্ত্রসিদ্ধান্ত।


সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রাকৃত লৌকিক যুক্তশীলতায়, এতদ্‌বিষয়ে কার্য্যকারন সম্পর্কের ব্যাখ্যায় স্বীকৃত প্রত্যক্ষ, অধিক হর্ষ-বিষাদজনিত কারনে অন্তঃকরন চঞ্চলতা প্রাপ্ত হয়। এই চঞ্চলতা বশতঃ ক্রিয়া-কর্ম্মাদিতে কাঙ্খিত একাগ্রতা-নৈপুন্যতা স্বাভাবিক ব্যহত হয়। তাৎক্ষণিক ভাবজাত প্রবৃত্তি, বৈদিক কর্ম্মানুষ্ঠানের নিয়ামক রূপে স্বীকৃত নয়। অতঃ শাস্ত্রীয় অনুশাসনে, সবিশেষ আনন্দ-শোক-উদ্বেগ জনিত মনবৈকল্য প্রশমনে বর্ণধর্মানুসার আত্মীকৃত শিক্ষাতারতম্যে, অশৌচ কালভেদ সূচীত হয়। অশৌচ কাল পরিমাপ প্রতীকি। ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রমীর পালনীয় দশাহ অশৌচ কাল, চতুর্বেদ ও ষড়বেদাঙ্গের সন্মিলিত শিক্ষার রূপকে গৃহীত। ব্রাহ্মণ শ্রৌতশিক্ষায় সাময়িক মানষিক হর্ষ-বিষাদাদি অবস্থা অতিক্রমন করে স্ববৃত্তিতে যথাযথ পুণঃস্থিতি প্রাপ্ত হয়। ক্ষত্রিয় বর্ণাশ্রমী আদিত্যধর্মী। আদিত্য যেরূপ দ্বাদশ রাশিচক্র অতিক্রমনান্তর সূচনাদশায় প্রত্যাবর্তন  করে, অনুরূপ, দ্বাদশাহ অশৌচান্তে ক্ষত্রিয় পুনঃ স্ববৃত্তিতে অধিকার লাভ করে। ধান্যাদি শষ্য যেরূপ ন্যুনাধিক পঞ্চদশ সপ্তাহে বীজ হতে বীজে পরিবর্তিত হয়, তদনুরূপ বৈশ্য বর্ণাশ্রমী পঞ্চদশাহ অশৌচান্তে পূর্ব্বাবস্থা প্রাপ্ত হয়। আর, যেহেতু শুদ্র বর্ণাশ্রমীর স্বাধীন বৃত্তি অস্বীকৃত, সেক্ষেত্রে মনবৃত্তির সাধারণ গতি চন্দ্রসাম্যে গৃহীত। চন্দ্র যেমন ত্রিশতিথিগত পক্ষাবর্তনে সূচনাতিথি প্রাপ্ত হয়, শুদ্র অনুরূপে ত্রিশাহ অশৌচান্তে স্ববৃত্তস্থতা প্রাপ্ত হয়।৷
৷৷৷৷৷৷৷৷৷  ৷ (লেখক শ্রী  মানিক চক্রবর্তী )৷৷৷৷৷৷  

Ekadoshi

লক্ষ্মীপুর চন্দ্রগঞ্জ থানা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন

  চন্দ্রগঞ্জ  প্রতিনিধি : বর্ণাঢ্য আয়োজনে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানা শাখার ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন...

চারবর্ণের অশৌচ ব্যবস্তা