উপনয়নেনারীর অধিকার
"""""""""""""""""""""""
আজকের আলোচনার বিষয় হল-
উপনয়নে নারীদের অধিকার আছে কি নাই। এই বিষয়ে আমাদের প্রাণাধিক পবিত্র বেদ থেকে নিম্নে ১০টি মন্ত্র অনুবাদ সহ তুলে ধরা হইল-দেখা যাক্ পবিত্র বেদ কি বলে-
পবিত্র বেদ মন্ত্র-১০টি
ব্রহ্মচারীষ্ণংশ্চরতি রোদসী উভে তস্মিন দেবাঃ সন্মানসো ভবনন্তি। স দাধার পৃথিবীং দিবং চ স আচার্যং তপসা পিপর্তি।।১
ব্রহ্মচারীণং পিতরো দেবজনাঃ পৃথগ্ দেবা অনুসংযন্তি সর্বে।
গন্ধর্বা এনমম্বায়ন্ ত্রয়স্ত্রিংশৎ ত্রিশতাঃ ষটসহস্রাঃ।সর্বানৎস দেবাংস্তপসা পিপর্তি।।২
আচার্য উপনয়মানো ব্রহ্মচারিনং কৃণুতে গর্ভমেন্তঃ। তং রাত্রীস্তিস্র উদরে বিভর্তি তং জাতং দ্রষ্টমভিসংয্তি দেবা।।৩
ইয়ং সমিৎ পৃথিবী দ্যৌর্দ্বিতীয়োতান্তরিক্ষং সমিধ পৃনাতি। ব্রহ্মচারী সমিধা মেখলয়া শ্রমেণ লোকাংস্তেসা পিপর্তি।।৪
পূর্বো জাতো ব্রহ্মণা ব্রহ্মচারী ঘর্মং বসানস্তপসোদতিষ্ঠৎ। তস্মাজ্জাতং ব্রাহ্মণং ব্রহ্ম জেষ্ঠং দেবাশ্চ সর্বে অমৃতেন সাকম।।৫
ব্রহ্মচার্যেতি সমিধা সমদ্ধিঃ কার্ষ্ণং বসানো দীক্ষিতো দীর্ঘশ্মাশ্রুৎ।
স সদ্য এতি পূর্ব স্মাদূত্তর সমুদ্রং লোকানৎসংগৃভ্য মুহুরাচরিক্রৎ।।৬
ব্রহ্মচারী জনয়ন ব্রহ্মাপো লোকং প্রজাপতিং পরমেষ্ঠিনং বিরাজম।
গর্ভো ভূত্বামৃতস্য যোনাবিন্দ্রো হ ভূত্বাসুরাংস্তর্হ।।৭
আচার্যস্ততক্ষ নভসী উভে ইমে উর্বী গভীরে পৃথিবীং দিবং চ।
তে রক্ষতি তপসা ব্রহ্মচারী তস্মিন দেবাঃ সম্নাসো ভবন্তি।।৮
ইমাং ভূমিং পৃথিবীং ব্রহ্মচারী ভিক্ষামা জভার প্রথমো দিবং চ।
তে কৃত্বা সমিধাবুপান্তে তয়োরার্পিতা
ভূবনানি বিশ্বা।।৯
অর্বাগন্যঃ পরো অন্যো বিস্পৃষ্ঠাদ্ গুহা নিধী নিহিতৌ ব্রাহ্মণস্য।
তো রক্ষতি তপস্যা ব্রহ্মচারী তৎ কেবলং কৃণুতে বৃহ্ম বিদ্বান।।১০
অনুবাদ-
ব্রহ্মচারী(ব্রহ্মচারী শব্দের অর্থ-যিনি বেদাত্মক ব্রহ্মে বিচরণশীল)নিজ তপস্যা দ্বারা দ্যাবাপৃথিবী ব্যাপ্ত করতে করতে স্বনিয়মে প্রবর্তিত হচ্ছে।সে ব্রহ্মচারীতে ইন্দ্রাদি সকল দেবগণ অনুগ্রহবুদ্ধিযুক্ত হয়।সে ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যায় পৃথিবী ও দ্যুলোক পোষণ করছে এবং সন্মার্গবৃত্তির দ্বারা নিজ গুরুকে পালন করছে।১
পিতৃগণ, দেবজন নামক দেবগণ ও
ইন্দ্রাদি অন্য দেবসকল ব্রহ্মচারীর রক্ষার জন্য পৃথক পৃথক তার অনুগমন করে।সেরূপ অন্ত রিক্ষচারী
বসু প্রভৃতি গন্ধর্বগণ এ ব্রহ্মচারীর অনুগমন করে।তেত্রিশ দেবতা (অষ্টবসু,একাদশ রুদ্র,দ্বাদশ আদিত্য, প্রজাপতি ও বষটকার) তার বিভূতিরূপ তিনশ তেত্রিশ দেবতা এবং তার বিভূতিরূপ ষট সহস্র সকল দেবতাকে সে ব্রহ্মচারী পালন করে।২
উপনয়ন কালে ব্রহ্মচারী মানবককে( এখানে "মানবক" শব্দটির দ্বারা পুং লিঙ্গ বুঝাচ্ছে) নিজের কাছে এনে আচার্য বিদ্যাশরীরের মধ্যে গর্ভ সঞ্চার করে তিন রাত্রি গুরুগৃহে রাখেন, তখন নিজ দেবতারা তার অভিমুখে আসেন।চতুর্থ দিবসে বিদ্যাময় শরীর থেকে উৎপন্ন ব্রহ্মচারীকে দেখার জন্য দেবতারা তার অভিমুখে আসেন।৩
এ পৃথিবী ব্রহ্মচারীর প্রথম সমিৎ, দ্যুলোক দ্বিতীয় সমিৎ এবং অন্তরিক্ষ অগ্নিতে আধীয়মান সমিধের দ্বারা পূর্ণ হয়। এরূপে ব্রহ্মচারী সমিধ মেখলা ইন্দ্রিয় -নিগ্রহরূপ শ্রম ও দেহসন্তাপক অন্যান্য নিয়মের দ্বারা পূর্বোক্ত পৃথিবীব্যাদির পালন করে।
(অতএব সমিদাধাদি কর্ম ব্রহ্মচারীর কর্তব্য ব্রহ্মচারী শব্দটা পুরুষ বাচক)। ৪
সর্ব জগতের কারণ সত্যজ্ঞানাদিলক্ষণ ব্রহ্ম থেকে ব্রহ্মচারী প্রথমে উৎপন্ন হয়েছে। সে উৎপন্ন হয়ে দীপ্ত রূপ আচ্ছাদন করে সমিদাধানাদি তপস্যার সাথে উত্থিত হয়েছে।অতএব ব্রহ্মচর্যাত্মক তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মের থেকে ব্রাহ্মণদের জ্যেষ্ঠত্ব( এই ঋকে ব্রাহ্মণ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে) উৎপন্ন হয়েছে। তার প্রতিপাদ্য অগ্নি প্রভৃতি সকল দেবগণ অমৃত্বতপ্রাপক স্বোপভোগ্যের সাথে উৎপন্ন হয়েছে। ৫
সকল সন্ধ্যায় অগ্ন্যাধান-জনিত তেজে সন্দীপ্ত,কৃষ্ণাজিন পরিহিত,দীক্ষিত (ভিক্ষাচরনাদি নিয়মযুক্ত অর্থাৎ উপনয়নকালে বা ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষালব্ধ লবন ব্যাতিত আহার করতে হবে, মাটিতে খরকুটার বা সাধারণ বিছানায় শয়ন করিতে হবে,রজগুণা পোশাক ও অলংকারাদি পরিহার করিতে হবে এবং সর্বপোরি একমাত্র মাতা ও গুরু ব্যাতিত নারী বা প্রকৃতি দর্শন নিষেধ করা হয়েছে)
দীর্ঘ- শ্মাশ্রু ব্রহ্মচারী পূর্ব সমুদ্র থেকে
উত্তর সমুদ্রে গমন করে অর্থাৎ তার তপস্যার মহিমা ব্যাপ্ত হয়। তিনি পৃথিবী, অন্তরিক্ষাদি লোক হাতে ধরে চলেন,অর্থাৎ সকল লোক বশীভুত হয়।৬
ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচর্য মহিমার দ্বারা ব্রাহ্মণ জাতি,(ব্রাহ্মণ শব্দটি পুরুষ বাচক সুতরাং এখানে ব্রাহ্মণ জাতিকে নির্দেশ করিতেছে! ব্রাহ্মণ জাতি বাচক বিশেষ্য পদ আর ব্রহ্মত্ব গুণ বাচক বিশেষ্য পদ। সুতরাং দুটোই আলাদা বিষয়)স্থান পানাদির জন্য গঙ্গাদি নদী, স্বর্গাদি লোক,প্রজাদের স্রষ্টা অবান্তর সৃষ্টিকারী প্রজাপতি, সত্যলোকে অবস্থানকারী আদি ব্রহ্মা পরমেষ্ঠী ও স্থুল- প্রপঞ্চ শরীরাভিমানী বিরাট পুরুষকে উৎপন্ন করেছে।(স্ব স্ব কারণ থেকে উৎপন্ন এদের ব্রহ্মচর্যই নিমিত্ত কারণ বলে তাদের আশ্রয়ভূত ব্রহ্মচারীতে আরোপ করা হয়েছে।)অমরণশীল ব্রহ্মের সত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণাত্বিকা প্রকৃতিতে প্রথম ব্রহ্মাচারী গর্ভ লাভ করে সব কিছু উৎপন্ন করেছে।৭
পরিদৃশ্যমান বিস্তীর্ণ অপরিছন্ন দ্যুলোক ও ভূলোক আচার্য উৎপন্ন করেছেন।সে দ্যাবাপৃথিবীর উৎপাদক
আচার্যকে ব্রহ্মচারী নিজ তপস্যার বা ব্রহ্মচর্যের নিয়মের দ্বারা পালন করে।৮
এ বিস্তীর্ণ পৃথিবী ব্রহ্মচারী প্রথম ভিক্ষারূপে সংগ্রহ করেছে,পরে দ্বিতীয় ভিক্ষারূপে দ্যুলোক করেছে।
ভিক্ষার দ্বারা লব্ধ এ দ্যাবাপৃথিবীকে সমিধ-রূপে অগ্নির পরিচর্যা করছে। সকল প্রাণী এ দ্যাবাপৃথিবী আশ্রয় করে রয়েছে। ৯
দ্যুলোকের উপরিভাগ থেকে অধো ভূলোকে এক বেদরূপ নিধি আচার্য হৃদয়রূপ গুহায় নিহিত হয়েছে।তার প্রতিপাদ্য দেবতারূপ অপর নিধি ওপরে অজ্ঞাত গুহায় নিক্ষিপ্ত রয়েছে। বেদ অধ্যায়নকারী ব্রাহ্মণের
সে নিক্ষিপ্ত নিধি - দুই ব্রহ্মচারী তপস্যার দ্বারা (ব্রহ্মচর্য নিয়মের দ্বারা) রক্ষা করছে।বেদার্থ রহস্যভিজ্ঞা বিদ্বান শব্দ ও তদর্থাত্মক বেদরাশির অধিষ্ঠানরূপ ব্রহ্ম সাক্ষাৎ করে থাকেন।১০
আলোচনা-
উপরোক্ত পবিত্র বেদ মন্ত্র থেকে আলোচনা করিলে দেখা যায় যে- উপনয়নে নারীদের অধিকার নাই এবং এটাই পবিত্র বেদের সিদ্ধান্ত। বিবাহের মাধ্যমেই নারীদের দশটি সংস্কার পূর্ণ হয়ে যায়। পবিত্র বেদে কয়েকজন ব্রহ্মজ্ঞানী মন্ত্র দ্রষ্টা নারী দেখা যায়।কিন্তু তাঁদের উপনয়ন হয়েছে এমন কথা বলা নাই।তাহাছাড়া সে নারীদের সৃষ্টি আমাদের সাধারণ মানুষের মত হয়নি।তাঁরা বিশেষ ভাবে সৃষ্টি হযেছেন অর্থাৎ তপবলে সৃষ্টি হয়েছেন।সুতরাং তাদের সাথে আমাদের তুলনা করা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখানে ব্রহ্মচারীদের আচার সম্পর্কে বলা হয়েছে। ব্রহ্মচর্য চলাকালিন কোন মানবক একমাত্র মাতা ও আচার্যগুরু ব্যাতিত নারী বা প্রকৃতির সকল কিছুই দর্শন করা যাবে না। মাটিতে শয়ন ও লবন ব্যাতিত খাদ্য গ্রহণ করিতে হয়।
উক্তমন্ত্রে ব্রাহ্মণ জাতির কথা বলা হয়েছে এই মর্মে যে, ব্রাহ্মণ ব্যাতিত আর কারো বেদ অধ্যাপনা বা গুরুবিদ্যা প্রদান, যজন যাজন করতে পারবেনা সেই বিধায়।
ধর্মের মূল হল বিশ্বাস।সুতরাং সকল তর্কের উর্দ্ধে গিয়ে আমাদের সকল সনাতনীর উচিৎ হবে শ্রুতি ও স্মৃতির বিধি বিধান মেনে চলা।
শ্রী রামচন্দ্র,শ্রীকৃষ্ণ তাঁহারা সকলেই ব্রহ্মজ্ঞ ও পূর্ণ ব্রহ্মের অবতার।তাহা সত্যেও তাঁহারা কিন্তু অধ্যাপনা বা গুরুবিদ্যা এবং পৌরহিত্য কর্মে যান নাই।তাতে বুঝা গেল যে, তাঁরাও স্মৃতি ও শ্রুতির অবমাননা করেননি।তাহলে আমাদের মত সাধারণ মানবের মনে এত দ্বিধা দ্বন্দ থাকবে কেন?
পবিত্র বেদে কন্যার (অবিবাহিত নারীর) ব্রহ্মচর্যের কথা বলা হয়েছে, তবে তাহা উত্তম পতি লাভ করার জন্য।সেখানে কিন্তু পৈতার ধারণের কথা বলা হয়নি বা পৌরহিত্য করার কথা বলা হয়নি। এখন বুঝতে গিয়া যদি আমরা ভুল বুঝি দোষ শাস্ত্রের নয়, দোষ আমাদের জ্ঞানের।
উদাহরণ - তুলসী দেবী।যিনি নারায়ণকে স্বমীরূপে পাবার জন্য গভীর বনে গিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করে ছিলেন।
সুতরাং আমাদেরকে কর্মের ধারা বুঝতে হবে এবং তার পর কর্ম করতে হবে।
না পারিতো না করব।এই কর্ম ব্যাস্ত জীবনে এমনিতেই আমরা পথ হারা হয়ে পড়েছি।তার পরে আবার যদি নিজের দম্ভ অহংকারকে জাহির করার জন্য স্মৃতি ও শ্রুতির করা হয় অপমান, তবে দুঃখের সাথেই বলতে হয়- "হতভাগা এই হিদুজাতি"!
আজকাল দেখা যায় কিছু কিছু শিক্ষিত ব্যাক্তির মূঢ়তার কারণেই সনাতন ধর্মে হতে চলেছে হিংসা হানাহানী ও বিভাজন।
কিন্তু এর শেষ কোথায়?
ইহা শেষ হবার নয়, কারণ ধ্বংস না আসিলে প্রকৃতির ভার সমতায় আসবে না। শাস্ত্র বলে - মানুষ ধ্বংসের জন্যই সত্যের হানী ঘটিয়ে অন্যায় অপরাধ করে চলেছে, করে চলেছে অবিচার জোরজুলুম, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, ধর্মের নামে করে রাজনীতি,জমি দখল রাজ্য দখল ইত্যাদি ইত্যাদি ।
এরে কি ধর্ম বলে,হাঁ?আজ কিছু কিছু মানুষের কারণে ধর্ম অধর্মে রূপ নিতে চলেছে!
পরিশেষে আমার সাধারণ ক্ষুদ্রজ্ঞান থেকে এই টুকুই বলব যে-ধর্ম ও রাষ্ট্র আমাদের উপর যে বিধি বিধান ও দ্বায়ীত্ব দিয়েছেন তা যদি সততার সাথে যথা সাধ্য মত পালন করে যেতে পারি,তবেই আসতে পারে মানব জীবনে পরম শান্তি।
"আধিপত্য বিস্তারের জন্যই মানব মনে সৃষ্টি হয় হিংসা বিদ্বেষ ও বিভাজন, তার জন্য ধর্মকে করা হচ্ছে তার বিশেষ হাতিয়ার।"
বিঃদ্রঃ- লেখাটা খুব বড় হয়ে গেল বলে দুঃখিত। তাই লেখাতে ভুল ত্রুটিও হতে পারে। নিজ গুণে সকল গুণিজন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশাকরি।
সবাই ভাল থাকুন এই কামনা করি!
জয় ব্রহ্মবাদ!
কলমে-
শ্রীপবিত্র কুমার চক্রবর্তী
চাঁদপুর
১৩/০২/২০২২ইং