ঈশ্বরের নিরাকারত্ব বিষয়ে বেদ ও উপনিষদের মন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা এবং কিছু ভ্রান্তি নিরসনের ক্ষুদ্র প্রয়াসঃ
সনাতন ধর্মে ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার উভয়েই বলা হয়েছে ।পবিত্র বেদ ও উপনিষদে সাকার ও নিরাকার উভয় বিষয়ে বর্ণিত আছে ।
সনাতন ধর্মের কিছু সংখ্যক লোক ঈশ্বরের সাকারত্ব স্বীকার করতে চান না।তারা ও কিছু ধর্মীয় বক্তা নিজেদের মতবাদ রেখে অন্য মতবাদ বিষয়ে অনধিকার চর্চা করেন ।যে যে মতবাদে বিশ্বাসী সেই মতবাদ নিয়ে থাকেন ,অন্য মতবাদ খণ্ডণ করার কাজে মহা ব্যস্ত থাকলে নিজ মতবাদ লালন ও পালন করার সময় পাবেন কোথায়? তাছাড়া পরনিন্দা ও পরচর্চা সনাতন ধর্মে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।অন্য মতবাদের সমালোচনা করা পরনিন্দা ও পরচর্চার শামিল বলে আমি মনে করি।তাছাড়া আজকাল কিছু সংখ্যক আত্মজ্ঞানী বক্তা কিছু কিছু মন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন । এমন ও বক্তা আছেন যারা মন্ত্র ও শ্লোকের পার্থক্য বুঝেন না।গীতার শ্লোককেও মন্ত্র বলে চালিয়ে দেন।যারা কোনটি মন্ত্র কোনটি শ্লোক বুঝেন না তাদের ব্যাখ্যা কতটুকু সঠিক তা বুঝে নেবার ভার পাঠকদের উপর ছেড়ে দিলাম। কেউ বুঝে না বুঝে বাহবা দিয়ে থাকেন ।আমি মহামূর্খ এসব মহাজ্ঞানীদের বেদ ও উপনিষদের মন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা বিষয়ে আলোচনা করবো ।
যজুর্বেদের ৪০|৮নং মন্ত্রের সরলার্থ হলো, "যে এরূপ আত্মাকে জানে, সে ব্রহ্ম লাভ করে ।ব্রহ্ম শুদ্ধ, বিজ্ঞানানন্দ স্বভাব ও অচিন্ত্য শক্তিবিশিষ্ট; তিনি প্রাকৃত শরীর রহিত, অক্ষয়, স্নায়ুরহিত; সত্ত্ব, রজ ও তমগুণের দ্বারা অস্পৃষ্ট এবং কোনো পাপ তাকে স্পর্শ করে না।সে এরূপ উপাসক, সে অনন্তকাল যথাস্বরূপ নিজ প্রয়োজন ভোগ করে থাকে ।তিনি ক্রান্তদর্শী, মনীষী, জ্ঞান বলে সর্বরূপ ও ব্রহ্মরূপ হয়ে ব্রহ্ম লাভ করে থাকেন ।" মহাজ্ঞানীরা 'শরীররহিত' এ শব্দটির উপর ভিত্তি করে ঈশ্বরের কোনো শরীর বা অবয়ব নাই ব্যাখ্যা করে নিরাকারত্ব প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন ।কিন্তু এখানে 'প্রাকৃত শরীররহিত ' বলা হয়েছে ।অর্থ্যাৎ আমাদের মতো শরীর নেই ।ঈশ্বরের শরীর চিন্ময় ।তবে শরীর নেই বলা ঠিক নয়,তাঁর প্রাকৃত শরীর নেই বলতে হবে ।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ৬|৯নং মন্ত্রের সরলার্থ হলো, "এ জগতে তাঁর প্রভু কেহ নেই ,নিয়ন্তা ও কেহ নেই ।এমন কোনো লিঙ্গ বা চিহ্ন নেই যা দ্বারা তাঁকে অনুমান করা চলে ।তিনি সকলের কারণ, ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাতা দেবতাদেরও অধিপতি; তাঁর কোনো জনক বা অধ্যক্ষ নেই ।" মহাজ্ঞানীরা লিঙ্গ শব্দটিকে পুরুষ লিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ ইত্যাদি অর্থে প্রয়োগ করে বলেন যে,ঈশ্বরের কোনো লিঙ্গ নেই ।অর্থাৎ ঈশ্বর স্ত্রী বা পুরুষ নহেন।অথচ সনাতনীদের কেউ কেউ পুরুষ ও স্ত্রী দেবতা তৈরি করে ঈশ্বর হিসেবে পূজা করে ।এ হলো সাকারবাদীদের বিরোধীতাকারী সনাতনীদের বক্তব্য ।প্রকৃতপক্ষে, এখানে লিঙ্গ শব্দের অর্থ চিহ্ন বা প্রতীক ।অর্থাৎ ঈশ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিহ্ন বা প্রতীক নেই ।আর ঈশ্বর ও দেবতাকে একত্রে গুলিয়ে ফেলে সনাতনীদের বৃহদাংশ বহু ঈশ্বরবাদী বলে ভুল ধারণা দেন।আসলে দেবতা ও ঈশ্বর এক নয় তা উপনিষদের মন্ত্রেও পরিষ্কার ।উক্ত শ্লোকে ইন্দ্রিয়াদি সকল দেবতার অধিপতি যে ঈশ্বর তা বলা হয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বর ও দেবতা এক নন।
অন্যদিকে সমালোচনাকারীরা জনক অর্থে পিতা বুঝে থাকেন এবং বলেন যে,ঈশ্বরের অবতারদের জনক বা পিতা আছে ,লৌকিক পিতা।কিন্তু তা ঈশ্বরের জনক বা পিতা বলা গ্রহণযোগ্য নয়।আলোচ্য মন্ত্রে জনক শব্দের অর্থ প্রভু বা মালিক বুঝানো হয়েছে । একটি শব্দের বিভিন্ন অর্থ থাকতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে ২০|২৫বছর আগের একটি সত্য ঘটনার কথা বলছি।আমি একবার হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি যাবার সময় এক ভদ্রলোক তার পাশে বসা লোকদের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, " বাংলাদেশের মাইনষে ( মানুষে) কইন (বলেন) শেখ মুজিব আমরার জাতির জনক মাইনে ( মানে) জাতির বাবা মাইনে আমরার মার জামাই ( স্বামী)।কতো বড় বেক্কল আমরা ? " তবে তিনি বেক্কল এর সমার্থক আঞ্চলিক কাঁচা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যা ফেইসবুকে উল্লেখ করবার মতো নয়।শব্দটি আ+চু যোগে।কেউ প্রতিবাদ করলো না।আমার ও উনার ভঙ্গি দেখে মান সম্মানের ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস হলো না।উনি যদিও আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছিলেন; কিন্তু উনার বেশভূষা দেখে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত মনে হলো ।কিন্তু এখানে বঙ্গবন্ধুকে জাতির তথা বাঙালী জাতির জনক বলা হয়েছে, কোনো বাঙালী লোকের তথা জনগণের জনক বা পিতা বলা হয়নি ।আর এখানে জাতির জনক মানে জাতির তথা বাঙালী জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বলা হয়েছে ।তাহলে বুঝুন কি অপব্যাখ্যা? এভাবে বিভিন্ন শাস্ত্রের সহজ শব্দেরই যাচ্ছেতাই ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ।আর বেদবাক্যের সঠিক ব্যাখ্যা আমার মতো শত পণ্ডিতের পক্ষে ও দুরূহ ।
আর অবতার সরাসরি ঈশ্বর নন, ঈশ্বরের ছায়া শক্তি যার ক্ষমতা ঈশ্বরের মতো বলে সাকারবাদীরা বিশ্বাস করেন।আর দেবতারা হলেন মায়াশক্তি ।কাজেই, এভাবে ভুল বুঝিয়ে দলভারী করা ঠিক নয়।সনাতন ধর্মে দেবতা পূজা বিরোধী একদল মতবাদী আছেন তা জানতাম ।অবশ্য তাদের কেউ কেউ দেবতা পূজা না করলেও দেবতাকে অবজ্ঞা করেন না এবং বলেন যে,কৃষ্ণের পূজা করলে অন্য দেবতার পূজার দরকার নেই ।কিন্তু ফেইসবুক সুবাদে জানতে পারলাম, সনাতনীদের একদল দেবতার অস্তিত্বই অস্বীকার করেন ।আর ঈশ্বর নিরাকার এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন । দেবতা ঈশ্বরের শক্তি অস্বীকার করায় অবাক হলাম ।আমি সনাতনী নিরাকারবাদীদেরকেও সনাতন ধর্মের অংশীদার বলে মনে করি ।তাদের মতবাদকেও শ্রদ্ধা করি।কিন্তু কেউ সাকারবাদীদের বিরোধীতা করলে আমার গুরুতর আপত্তি ।
এবার সনাতনী শুধু নিরাকারবাদীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ঈশ্বরের যদি চোখ না থাকে, তাহলে সবকিছু দেখেন কীভাবে, আর কান না থাকলে আমাদের সবকথা শুনেন কীভাবে? তাহলে ঈশ্বর সবকিছু দেখেন এবং শুনেন তা কি নিরাকারবাদী সনাতনীরা অস্বীকার করবেন ?তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিরাকারবাদীরা ও বেদ মানেন এবং বেদ ঈশ্বরের বাণী বলে বা ঐশী বাণী বলে মানেন ।ঈশ্বরের মুখ না থাকলে বাণী দেবেন কীভাবে? হয়তো বলবেন, ঈশ্বরের বাণী বা সত্য মুনিঋষিরা উপলব্ধি করেছেন ।দৈববাণী না হলে তাঁরা শুনলেন কীভাবে? আর বেদ ঈশ্বরের বাণী না হলে তো বুঝতে হবে তা মুনিঋষিগণের চিন্তার ফসল ।
তবে হ্যাঁ, ঈশ্বরের চক্ষু, কর্ণ, মুখ কিরূপ তা ঈশ্বরই জানেন।অবতার হিসেবে ঈশ্বরের সাকার রূপ মানুষ দর্শন করতে পারে; কিন্তু ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ দর্শন করা ও উপলব্ধি করা কঠিন ।
সনাতন ধর্মের বেদকে সনাতনী সবাই মানেন, এমনকি অন্য ধর্মের লোক ও স্বীকার করেন।কিন্তু কোনো কোনো সময় নিজ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে মন্ত্র ও শ্লোকের ভুল ব্যাখ্যা কাম্য নয়।
আমরা সনাতনীরাই যদি ঈশ্বরের সাকার নিরাকার নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে অন্য ধর্মের লোক সনাতন ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নিলে কি করবেন ? কাজেই ,সনাতনী ভাইবোনদের কাছে অনুরোধ, আসুন আমরা সকল মতকে শ্রদ্ধা করে একই ছায়াতলে আশ্রয় নেই এবং অন্য ধর্মকে ও শ্রদ্ধা করি।তারপরও যদি কেউ নিজস্ব মতবাদ আঁকড়ে ধরতে চান তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই ।তবে অন্য মতবাদের সমালোচনা করতে বিবেক ও বুদ্ধি খাটাবেন।সাকার থেকে নিরাকারে পৌঁছা যায় ।কিন্তু আমরা সনাতনীরা যদি নিরাকার নিয়ে বসে থাকি তাহলে শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ সৃষ্টি হবে যা চার্বাক মুনির হয়েছিল ।আমরা কেউ চার্বাক মুনি হতে চাই না,চাই না চার্বাক দর্শনের অনুসারী হতে।
আমার পোস্টের গুরুত্ব অনুধাবন করে আলোচনাসহ ভদ্রোচিত ভাষায় মন্তব্য করলে আমি কৃতার্থ হবো ।আমার জ্ঞান বুদ্ধির জোরে আলোচনা করলাম ।ভুল ভ্রান্তির পরম করুণাময় ও প্রাজ্ঞজনের নিকট ক্ষমা প্রার্থী ।
No comments:
Post a Comment